পিআর পদ্ধতি ন্যায্যতা ও বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক বাস্তবতায় এটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং এটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে।
লোকমান আহমদ
সারসংক্ষেপ : বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুপাতভিত্তিক ভোট (Proportional Representation-PR) পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু ছোট রাজনৈতিক দল দাবি তুলেছে, এই পদ্ধতি চালু হলে তাদেরও সংসদে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে। তবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ধরেই এর বিরোধিতা করে আসছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পদ্ধতি নিয়ে তেমন কোনো সচেতনতা নেই; বরং অধিকাংশ মানুষ এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট (First-Past-the-Post ev FPTP) পদ্ধতিতেই অভ্যস্ত।
পিআর পদ্ধতি ন্যায্যতা ও বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক বাস্তবতায় এটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং এটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে।
ভূমিকা : গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন এবং তাদের প্রতিনিধিদের জবাবদিহি। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি, যেখানে একটি আসনে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হন। এর ফলে একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে। তবে এই ব্যবস্থায় ছোট দল ও সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ইউরোপের বহু দেশ, যেমন জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন প্রভৃতি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে। এসব দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে এই পদ্ধতি টেকসই হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন, তাই প্রশ্ন উঠছেÑএদেশে পিআর পদ্ধতি চালুর দাবি কতটা যৌক্তিক?
পিআর পদ্ধতি কী
পিআর পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বরাদ্দ করা হয়। সাধারণত ভোট সরাসরি কোনো প্রার্থীর জন্য নয়, বরং দল বা দলের তালিকার জন্য দেওয়া হয়। এর ফলে প্রত্যেকটি ভোট সংসদে কোনো না কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়।
পিআর পদ্ধতির সুবিধা
১. ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ-প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে; ‘ভোটের অপচয়’ কমে।
২. ছোট দল ও সংখ্যালঘুর অংশগ্রহণ-বৃহৎ দলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য কমে, রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়।
৩. গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি-ভিন্ন মতাদর্শ, আঞ্চলিক স্বার্থ ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর সংসদে প্রতিফলিত হয়।
৪. দলীয় জবাবদিহি বৃদ্ধি-ভোটাররা প্রার্থীর চেয়ে দলীয় নীতি ও কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দেন।
পিআর পদ্ধতির অসুবিধা
১. দুর্বল সরকার গঠনের ঝুঁকি-জোট সরকারে ভাঙন ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
২. নীতিগত অচলাবস্থা-সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘ সময় লাগে, নীতি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব হ্রাস-সরাসরি জনগণের সঙ্গে জনপ্রতিনিধির সম্পর্ক দুর্বল হয়।
৪. ছোট দলের অতিরিক্ত প্রভাব-সংসদে ব্ল্যাকমেলিং প্রবণতা বাড়তে পারে।
৫. আইন প্রণয়ন ব্যাহত-সংসদে বিভাজন বৃদ্ধি পায়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আটকে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধকতা
১. আইনি সীমাবদ্ধতা-বাংলাদেশের সংবিধান সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট-পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে। পিআর চালু করতে সাংবিধানিক সংশোধন অপরিহার্য।
২. রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতা-প্রধান দুই দলের দ্বন্দ্বপূর্ণ রাজনীতির কারণে কার্যকর জোট সরকার গঠন কঠিন।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা-নির্বাচন কমিশন, সংসদীয় প্রথা ও প্রশাসনিক কাঠামো এখনো পর্যাপ্ত শক্তিশালী নয়।
৪. দুই দলের আধিপত্য-আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে ছোট দলগুলোর প্রভাব সীমিত; পিআর চালু হলে তারা শুধু জোটে চাপ প্রয়োগ করে সুবিধা নেবে।
৫. স্থিতিশীলতার প্রয়োজন-উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
৬. জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হওয়া-সরাসরি প্রার্থী নয়, দলকে ভোট দেওয়ার কারণে গ্রামীণ জনগণ তাদের স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক হারাবে।
৭. গ্রামীণ বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্য-বাংলাদেশের অধিকাংশ ভোটার এখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক; তারা দলীয় তালিকার পরিবর্তে পরিচিত স্থানীয় প্রার্থীকে পছন্দ করেন।
তুলনামূলক দৃষ্টান্ত
ভারত : বাংলাদেশের মতো ভারতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট-পদ্ধতি বহাল রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারত পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করেনি, কারণ সেখানে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
জার্মানি : মিশ্র ভোট-ব্যবস্থা চালু আছে-অর্ধেক আসনে সরাসরি ভোট, অর্ধেক আসনে পিআর-ভিত্তিক বণ্টন। উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সমঝোতার সংস্কৃতির কারণে এটি কার্যকর হয়েছে।
নেপাল : সম্প্রতি পিআর-ভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করেছে, তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের কারণে কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়
বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি এখনই বাস্তবায়ন করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ভবিষ্যতে কিছু শর্ত পূরণ হলে মিশ্র পদ্ধতির দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে :
১. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা।
২. সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি শক্তিশালী করা।
৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহনশীলতা ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করা।
৪. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে পিআর পদ্ধতির মৌলিক ধারণা প্রচার করা।
৫. প্রথমে আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে পিআর চালু করা।
উপসংহার
পিআর ভোট-পদ্ধতি গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার একটি তাত্ত্বিক হাতিয়ার হলেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতায় এটি কার্যকর হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি। বরং এটি রাজনৈতিক বিভাজন বাড়িয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠনের ঝুঁকি তৈরি করবে। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন পিআর ভোট-পদ্ধতিকে আমলে নেয়নি। সম্প্রতি তাদের ভাষ্যে জানা যায়, যা ইতোমধ্যে আইনে নেই, তা তারা গ্রহণ করতে পারবে না।
বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বিদ্যমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট-পদ্ধতির স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দৃঢ় হলে মিশ্র ভোট-ব্যবস্থা (FPTP + PR) নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
অতএব, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট-পদ্ধতিই অধিক উপযোগী, কারণ এটি স্থিতিশীল সরকার গঠন, স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশা পূরণ ও জাতীয় উন্নয়ন ধারাবাহিক রাখতে সহায়ক।