রাজশাহীর ছয়টি আসনের মধ্যে চারটিতে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি প্রকট হয়ে উঠেছে। মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন। পরস্পরের বিরুদ্ধে তারা চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ তুলছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে একে অপরের চরিত্র হননের চেষ্টা। এক গ্রুপের ওপর আরেক গ্রুপের হামলা ও সহিংসতাও থেমে নেই। প্রতিপক্ষের হামলায় ইতোমধ্যে তিন কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। পালটাপালটি মামলাও হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের নেতিবাচক প্রতিযোগিতা দুঃখজনক। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে দ্বন্দ্ব সবচেয়ে বেশি। দলীয় সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী গনিউল হক এবং কৃষক দল নেতা নেকশার আলী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন, গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানুল ইসলাম তারেক, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সাজেদুর রহমান মার্কনি, জিয়া পরিষদের নেতা অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব এবং প্রকৌশলী কেএম জুয়েল। এখানে শরীফ উদ্দিন এবং তারেকের অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সবচেয়ে প্রকট। তাদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর গোদাগাড়ী উপজেলা সদরে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি নাসির উদ্দিন বাবুসহ সাতজন আহত হন। এ নিয়ে পালটাপালটি মামলা হয়। গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়ালসহ কয়েকজন নেতার ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে।
গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মনোনয়ন ইস্যুতে বৈরী প্রতিযোগিতার বিষয়টি সত্য। তবে নানা কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমরা তার পক্ষেই কাজ করব। স্থানীয়রা মনে করছেন-বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এ আসনে জামায়াত প্রার্থী অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু এবং মহানগর বিএনপির সদ্য সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা। মিনু ও তার ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে আছেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ-সদস্য মিনুর রয়েছে ক্লিন ইমেজ। দলমত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা থাকায় মনোনয়ন দৌড়ে মিনু এগিয়ে রয়েছেন বলে দাবি তার অনুসারীদের।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে বিএনপির তিনজন মাঠে রয়েছেন। তারা হলেন-বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহসম্পাদক এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন, রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রায়হানুল আলম রায়হান এবং সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কবির হোসেনের ছেলে নাসির হোসেন। তবে সক্রিয় রয়েছেন মিলন ও রায়হান।
শফিকুল হক মিলন বলেন, বিএনপি বড় দল। তাই মনোনয়নের প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। যে যার মতো মাঠে রয়েছেন। আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান, সদস্য সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন, রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক সহসম্পাদক ড্যাব নেতা ডা. আশফাকুর রহমান শেলী। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখানে বিএনপির একটি অংশের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা দখলবাজিতে নেমেছে। উপজেলাজুড়ে শুরু হয়েছে পুকুর দখল ও খননের মহোৎসব। থেমে থাকেনি জমি দখলও। চলছে চাঁদাবাজি। সবমিলিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বাগমারা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক রাশেদুজ্জামান রাসেল বলেন, উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মহব্বত হোসেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়কের পদ থেকে তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।
মনোনয়নপ্রত্যাশী ডিএম জিয়ার ভাই ও আউচপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাফিকুল ইসলাম শাফির বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। শাফিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জিয়ার বিরোধীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ হাট-বাজার ও গ্রাম-গঞ্জে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ডিএম জিয়া বলেন, আমি কারও বিরুদ্ধে বলি না। আমার অনুসারীরাও এমনটি করেন না। যাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব রয়েছে তারা না বুঝে এমন করছেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাই বলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো নয়। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার জন্য আমরা মাঠে কাজ করব।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে রয়েছে বিএনপির প্রার্থীর ছড়াছড়ি। বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও পুঠিয়া উপজেলার আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক, বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবিবা, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি রুকুনুজ্জামান আলম, জিয়া পরিষদের কেন্দ্রের সহকারী মহাসচিব সিরাজুল করিম সনু, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডল, সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফার ছেলে জুলকার নাঈম মোস্তফা এবং ব্যবসায়ী ইশফা খায়রুল হক শিমুল মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।
এখানে ১৫ মে দলীয় কোন্দলে বিএনপি কর্মী হাসিবুল ইসলাম খুন হন। দলের ১০ নেতাকর্মী আহত হন। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব জোবায়েদ হোসেনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনুসারীরা একে অপরের প্রতি বিষোদগার করছেন। দলীয় কর্মসূচি পালটাপালটি পালিত হচ্ছে।
যুবদল নেতা গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সবারই রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে থাকা উচিত। আমরা অসহিষ্ণু হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন-জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল, দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবাশীষ রায় মধু, জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন, বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বজলুর রহমান। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঘনিষ্ঠদের অনেকের বিরুদ্ধে জমি ও বালুমহাল দখল এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।