আজকের এই শিরোনামে আমি কলম ধরেছি একান্ত প্রয়োজনে। কারণ, এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দাবি রাখেন দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী গুণীজন, শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকরা। প্রকৃত অর্থে তাঁদেরই উচিত ছিল শিক্ষাব্যবস্থার নৈতিক শূন্যতা ও এর পরিণতি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা এবং জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেই প্রাপ্য কণ্ঠগুলো আজ নীরব। ঠিক সেই নীরবতার শূন্যস্থানে জায়গা থেকে আমাকে এই বিষয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে।
একটি জাতির উন্নতির মেরুদণ্ড হলো তার শিক্ষা ব্যবস্থা। বাংলাদেশ আজ নানা সংকটে জর্জরিত— বেকারত্ব, দুর্নীতি, মেধা পাচার,নৈতিক অবক্ষয়। এই সমস্ত সমস্যার মূল শিকড় খুঁজে দেখলে দেখা যায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত নয়; এটি মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষা-কেন্দ্রিক এবং মানবিক মূল্যবোধশূন্য।
তাই এখন প্রশ্ন একটাই—শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া জাতি কি সত্যিই মুক্তি পেতে পারে?
মানুষের নৈতিক চরিত্র মূল্যবোধ জেগে ওঠে যে শিক্ষার আলো থেকে সত্যিকার অর্থে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সেই মানের প্রতিফলন ঘটেছে?
প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে বের হয়। তাঁদের হাতে থাকে ডিগ্রি, মস্তিষ্কে থাকে আধুনিক জ্ঞানের আলো। কিন্তু বাস্তবতা ক্রমে প্রশ্ন রাখে—এই শিক্ষার আলো কি তাদের চরিত্রে ছাপ ফেলছে, নাকি শুধুই চাকরির টিকিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব গ্রহণ করছে। এদের অনেকেই মেধা, যোগ্যতা ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে সমাজে সম্মানিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্মস্থলে ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে, যা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং প্রশাসনে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করছে। উচ্চশিক্ষায় আলোর আলোকিত সমাজ এবং রাষ্ট্রকে অন্ধকারের দিকে নিমজ্জিত করছে।
আধুনিক শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় পরিচালনা অংশের দায়িত্বে হলেও আদর্শ এবং নীতিগত দিক আত্মঘাতীতে পরিণত হচ্ছে। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি কাজের জন্য ঘুষ অনিয়ম করাটা কে প্রচলিত আইন বলে বিবেচিত করছে।
সচিবালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত দুর্নীতির লাগামহীনতার জন্য জেনারেশন ওগুলো প্রথা হিসেবে বিবেচিত করছে।
পাশাপাশি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রধানত ধর্মীয় জ্ঞান প্রদান করে, কিন্তু আধুনিক শ্রমবাজারের চাহিদামতো দক্ষতা ও সনদের অভাব থাকার কারণে এটি বাংলাদেশের বেকারত্বের একটি অংশের জন্য আংশিক ভাবে দায়বয় বহন করে।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা কারণে অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় আদর্শ এবং নৈতিক চরিত্রের বিকাশিত হলেও আধুনিক শিক্ষায় এবং কারিগরি শিক্ষা থেকে দূরে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় কিম্বা বেসরকারি চাকরি বাজারে তাদের অনুপস্থিতি। ফলে দেশে বেকারত্বের ছাপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে বেকারত্ব ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে মাদ্রাসা এবং সাধারণ শিক্ষা উভয়ই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি—-
সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিশন গঠন করে বাস্তবমুখী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
একক চিন্তা: উভয় ধারার শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা।
পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার: মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বাদ দিয়ে এমন মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা সৃজনশীলতা, সততা ও দায়িত্ববোধ যাচাই করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি: ভর্তি, পরীক্ষার ফলাফল ও নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয়: ধর্মীয় শিক্ষা ও আধুনিক নৈতিক শিক্ষা একত্রে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সঠিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠে।
দক্ষতা উন্নয়ন: চাহিদাভিত্তিক দক্ষতা যেমন আইটি, ডেটা সাইন্স, ইলেকট্রনিক্স, পর্যটন, ও পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া।
মাদ্রাসা শিক্ষা: ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT), এবং সাধারণ গণিতকে গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করে মাদ্রাসার সনদকে সাধারণ শিক্ষার সমমানের করা।
সাধারণ শিক্ষা: পাঠ্যক্রমকে আরও প্রায়োগিক ও হাতে-কলমে শেখার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা, যাতে মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি হয়।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা শেখানো:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ও স্বচ্ছতার চর্চা করা, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার ধারণা তৈরি করবে।
শিক্ষার্থীদের নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উৎসাহিত করা।
শিক্ষকের মানোন্নয়ন:
শিক্ষকদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাদানে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের আধুনিক ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দেওয়া।
শিক্ষকদের নৈতিক প্রশিক্ষণ:
শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে তারা নিজেরা আদর্শ হয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন।
নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা:
মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমে ইসলামী মূল্যবোধ যেমন স্বচ্ছতা (আমানত), ন্যায়বিচার (আদল) এবং জবাবদিহিতা-এর ওপর জোর দেওয়া, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরি করবে।
সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সততা, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ, ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধার মতো নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধকে পাঠ্যক্রমে স্পষ্টভাবে এবং কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা।
উভয় ক্ষেত্রে নীতিশাস্ত্র বা নৈতিক শিক্ষা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে পড়ানো এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখানো।
পরিশেষে বলবো বাংলাদেশের প্রশাসন ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে যে চরম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা যায়, তা শুধু ব্যক্তিগত লালসা নয়—এটি দীর্ঘদিনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার ফল।
বর্তমানে সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ইত্যাদি দেশগুলো আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।
ইসলামী দৃষ্টিতে, খলিফা হযরত উমর (রা.) এর সময়কার শাসনব্যবস্থাও এক প্রকার কল্যাণ রাষ্ট্রের আদর্শ রূপ।
তাই সত্যিকার অর্থে একটি শক্তিশালী এবং আদর্শবান রাষ্ট্রের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে সু-শিক্ষা। শুধু শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্র বানানো যায় কিন্তু আদর্শবান সভ্য জাতির রাষ্ট্র বানানো অসম্ভব।
শিক্ষা যদি মানুষ তৈরি করতে না পারে, আর রাষ্ট্র যদি সৎ মানুষকে জায়গা না দেয় — তাহলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং ন্যায়ের বিচারের জন্য ছাত্রজনতা কে বারবার রাজপথে আন্দোলনের নামতে হবে।
৫২ এর রফিক সালাম জব্বার বরকত থেকে শুরু করে ২৪ এর আবু সাঈদ মুগ্ধদের রক্তে সরকার পরিবর্তন হবে জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন কখনো আসবে না।
ছোট্ট বেলার সেই ছড়াটি মাধ্যমে আজ এ পর্যন্তই
_ খোকা ঘুমালো পাড়া ঘুমালো বর্গী এলো দেশে বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে!
মিসবাহ উদ্দিন আহমদ