বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ভারত দমছে না, থামছে না। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে দেশটির নানা উইং কাজ করছে পুরোদমে। বাংলাদেশের পাহাড় অশান্ত করে রেখেছে। টোকা দিচ্ছে নতুন করে। গন্ডগোল পাকাতে পাহাড়কে অস্থির করতে বিভিন্ন এনজিও নারীদেরকে সেনাবাহিনীর সামনে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশের তিন পার্বত্য জেলাকে পূর্ব তিমুরের মতো রাষ্ট্র বানানোর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সন্তু লারমারা ভারতে গিয়ে বৈঠকও করছে। অশান্ত পাহাড়ে ঘন ঘন বিদেশি প্রতিনিধিদের সফরও রহস্যঘেরা।
নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন-চীন সমীকরণও জোরদার। ঢাকায় রাষ্ট্রদূত মনোনীত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন এরই মধ্যে মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির শুনানিতে জানিয়েছেন তার প্রস্তুতি ও অপেক্ষার কথা। বলেছেন, বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি হবে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে। ঢাকায় এলে প্রতিরক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকির বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন বলেও জানিয়েছেন ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন। তার বিপরীত মতিগতি সেই তুলসী গ্যাবার্ডের।
তিনি বার্তাটি দিয়েছেন বাহরাইনে বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলন মানামা সংলাপে। এর আয়োজক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটি স্টাডিজ- আইআইএসএস। ওয়াশিংটনের বিগত সময়ের চিন্তাপদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে আটকে রেখেছে বলে মন্তব্য করেন তুলসী গ্যাবার্ড। তিনি বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি রেজিম চেঞ্জ বা জাতি গঠনের একধরনের ব্যর্থ চক্রে আটকে ছিল। এটি ছিল “সবার জন্য প্রযোজ্য” এমন একটি নীতি, যেখানে সরকার উৎখাত করা, অন্য দেশে আমাদের শাসনব্যবস্থা চাপানোর চেষ্টা করা এবং তেমন জানাশোনা ছাড়াই নানা সংঘাতে হস্তক্ষেপ করা এবং মিত্রের চেয়ে বেশি শত্রু তৈরি করে চলে আসা।’ অন্য দেশের সরকার বদল ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন নীতির সমাপ্তি হয়েছে জানিয়ে দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড কী বার্তা দিলেন, এ নিয়ে গোলকধাঁধায় কূটনীতি বিশ্লেষকেরা। বরং এর মাঝে বাড়তি তৎপরতা ও নীতি আঁচ করছেন অনেকে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং বঙ্গোপসাগরের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহ আরও বাড়ছে। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার তৎপরতা মেরুকরণের আভাস দিচ্ছে। আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দৃশ্যমান হলেও চীন ও রাশিয়ার অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের বিরোধ নতুন মাত্রায় দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এশিয়া সফর ছিল কূটনৈতিক নাটকীয়তার।
ক্ষমতায় আসার ৯ মাসের মধ্যে এটাই ছিল তার সবচেয়ে দীর্ঘ বিদেশ সফর। তিনি মূলত এশিয়া সফরে সাফল্য, গৌরব ও প্রদর্শনের রাজনীতি করেছেন। এশিয়া সফরজুড়ে ট্রাম্পকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছেন নেতারা। মালয়েশিয়া তাকে লালগালিচা পেতে স্বাগত জানিয়েছে। ট্রাম্পের জন্য রাজকীয় প্রাসাদে আয়োজন করা হয় গার্ড অব অনার, সামরিক ব্যান্ডের বাজনা ও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। জাপানের পক্ষ থেকে ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া উপহার দিয়েছে প্রয়াত নেতা ও ট্রাম্পের গলফ-সহচর শিনজো আবে ব্যবহৃত একটি গলফ ক্লাব এবং রাজধানীকে সাজাতে ২৫০টি চেরি ফুলের গাছ। দক্ষিণ কোরিয়া দিয়েছে প্রাচীন এক রাজবংশের স্বর্ণমুকুটের প্রতিরূপ, যা তাদের ভাষায়, ‘দূরদর্শী নেতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠার যোগ্য এক ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত উপহার’। আর বাংলাদেশ দূর থেকে দেখেছে। ভারত মিলিয়েছে তার হিসাব। দেশটির আদানি পাওয়ার লিমিটেডও পারলে বাংলাদেশে গোল বাধিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়েছে। বলেছে, ১০ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না হলে ১১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান অবিনাশ অনুরাগ ৩১ অক্টোবর বিপিডিবির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছেন, বিপিডিবি এখনো ৪৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া পরিশোধ করেনি, যার মধ্যে ২৬২ মিলিয়ন ডলার বিপিডিবির নিজস্ব স্বীকৃত অপরিশোধিত বিল। চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ বন্ধ থাকলেও তারা ‘ডিপেন্ডেবল ক্যাপাসিটির’ ভিত্তিতে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পাওয়ার অধিকার রাখে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশকে। ভারতের অবিরাম ডিস্টার্ব রুখতে প্রতিরক্ষানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে জুলাইয়ের চেতনায় স্বাধীন ও শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের তাগিদ আসছে। ভূরাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে কৌশলগত দূরদর্শিতা দেখাতে প্রয়োজনে ভারতকে ছাড়াই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট- সার্ককে এগিয়ে নেওয়ার একটি পরিকল্পনা এগোচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস কয়েকবার এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি বা তার সরকার এ বিষয়ে স্লট তৈরি করে গেলে পরবর্তী সরকারের এ পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা সহজ হবে। গত মাস কয়েক ধরে এ-সংক্রান্ত একটি ডিল আবার জোরদার। চলছে ব্যাপক হোমওয়ার্ক। তাদের সাম্প্রতিক অপেক্ষা নতুন সরকারের।