কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থপাচার হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ অর্থপাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২২ লাখ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় ধাপের অর্থপাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। এছাড়া বেক্সিমকো, নাসা, বিসমিল্লাহ ও ক্রিসেন্ট গ্রুপও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, “বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিদেশে সম্পদ গড়ার তথ্যও আছে। কিন্তু এসব টাকা ফেরানোর ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আদালতের মাধ্যমে শাস্তি না হলে অর্থ ফেরানো সম্ভব নয়।”
পাচারের কৌশল:
অর্থপাচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। অস্তিত্বহীন কোম্পানি গঠন, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি, ভুয়া তথ্য প্রদান, জামানতের অতিমূল্যায়ন—এসব কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ জালিয়াতির সিন্ডিকেট গঠন করে এসব অপকর্ম সম্পন্ন হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের অর্থপাচার:
এস আলম গ্রুপের ব্যাংকিং খাতে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ধরা পড়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গ্রুপটির কর্ণধার এস আলম মাসুদ ভুয়া এলসি ও অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব অর্থ স্থানান্তর করেছেন। ইসলামী ব্যাংকসহ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়টি ব্যাংকের সহযোগিতায় এই যাত্রা সম্পন্ন হয়।
বেক্সিমকো, নাসা ও অন্যান্য গ্রুপ:
বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে শুধু এক শাখা থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, যার একটি বড় অংশ এলসি ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিদেশে গেছে। নাসা গ্রুপের নামে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ ৭টি ব্যাংক থেকে ভুয়া রপ্তানির প্রকল্প দেখিয়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। ক্রিসেন্ট ও অ্যানন টেক্স গ্রুপও যথাক্রমে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে।
অর্থপাচারের পরিসংখ্যান:
বিআইবিএম-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশের ব্যাংক ও বাণিজ্য ব্যবস্থা অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির সময় মিথ্যা তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক সুবিধা নিতে পারলেও, অর্ধেক ব্যাংক কার্যত অর্থপাচার রোধে অক্ষম।