December 1, 2025, 10:45 am
Title :
ফের অভ্যুত্থানে জেন-জি, উত্তাল এশিয়ার আরেক দেশ ‘সমুদ্রে অবৈধ ও অতিরিক্ত মৎস্য আহরণে মাছের সংস্থান কমে যাচ্ছে’ দেশের ৩৩ শতাংশ মানুষ রোগাক্রান্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একমাত্র সমাধান: পোপ লিও সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত সদস্যদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার: প্রধান উপদেষ্টা বেলুচিস্তানে এফসি সদর দপ্তরে হামলা, পাল্টা হামলায় ৩ সন্ত্রাসী নিহত হঠাৎ পাল্টে গেলো বাংলালিংকের লোগো, সামাজিকমাধ্যমে চলছে আলোচনা কক্সবাজারে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা এবং কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সঙ্গে এবার রেহানা-টিউলিপের রায় সোমবার খালেদা জিয়ার অসুস্থতার জন্য হাসিনা সরকার দায়ী: রাশেদ খান

হযরত মুহাম্মদ (সা.) নাতি ইমাম হুসাইনের জন্মদিন বছরে দুইবার পালন করেন মিশরীয়রা

Reporter Name
  • Update Time : Friday, October 31, 2025
  • 34 Time View

কায়রোর ঐতিহাসিক হুসাইনি মসজিদের ভেতরে বসে শিরিন নামের এক নারী বলছিলেন, ‘আমি নিজে থেকে এখানে আসিনি, আমাকে ডাকা হলেই কেবল আমি আসতে পারি।’ তার বিশ্বাস, নবী মুহাম্মদ (সা.) নাতি ইমাম হুসাইনের মাজারে কেবল তার অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই প্রবেশ করতে পারেন। বহু মিশরীয় একই ধরনের বিশ্বাস রাখেন।

বিবিসি অ্যারাবিককে শিরিন বলেন, ‘ঠিক যেমন বিনা দাওয়াতে কেউ কারো বাড়িতে যেতে পারে না, তেমনি ইমাম হুসাইনের দর্শন পাওয়ার ব্যাপারটিও তাই। তিনি যদি না চান, তাহলে আপনি মাজারের সামনে পৌঁছে যাওয়ার পরও তার দর্শন না পেতে পারেন।’

কায়রোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ইমাম হুসাইনের মাজার, হাজারো দর্শনার্থীর কাছে যা আধ্যাত্মিক শান্তির স্থান। প্রতি বছর দুইবার এখানে পালিত হয় তার জন্মবার্ষিকী—শাবান মাসে তার আসল জন্মদিন এবং রবি-উস-সানি মাসের শেষ মঙ্গলবারে আরেকটি জন্মোৎসব। মিশরীয়রা দ্বিতীয় উদযাপনটিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। এ বছর তার জন্মদিন পালন করা হয়েছে ২১শে অক্টোবর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পৃথক বা ভিন্ন উদযাপনের পেছনে কারণ কী?

‘মিশরীয়দের আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম’

মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনে ইমাম হুসাইনের শির (মস্তক) ফিলিস্তিনের আশকেলন থেকে কায়রোতে পৌঁছেছিল। মিশরীয় সাংবাদিক নাওয়ারা নাজম বলেন, ‘ইমাম হুসাইনের আগমনের মাধ্যমে মিশরীয়রা নবী পরিবারের (আহলে আল-বাইত) সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়েছেন।’ তাদের বিশ্বাস, ইমাম হুসাইনের শির মিশরে পৌঁছানো দেশটির জন্য এক আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের সূচনা। কায়রোর হুসাইনি মসজিদের ইমাম ড. মোমিন আল-খালিজির ভাষায়, ‘এটি পালন মিশরীয়দের আনুগত্যের প্রকাশ।’

ইতিহাসবিদ ড. আব্দুল বাকি আল-কাত্তান জানান, অনেক গবেষক মনে করেন হিজরি ৫৪৮ সালের জামাদা আস-সানি মাসে ইমাম হুসাইনের শির কায়রোতে পৌঁছেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মৌলিদ অর্থাৎ হুসাইনের জন্মদিনটি পরের বছর আনা হয়। মিশরীয়রা এই দিনটিকে ‘ইশতবিশার’ বা ‘সুসংবাদের দিন’ হিসেবে পালন করে।

ইতিহাসের সাক্ষ্য

ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ইবনে আল-আযরাক আল-ফারকির তারিখ-ই-মিয়াফারাকিন নামক প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ আছে, ক্রুসেডারদের আক্রমণের আগে খলিফা জাফর আশকেলন থেকে ইমাম হুসাইনের শির মিশরে নিয়ে আসেন এবং সেখানে একটি মাজার নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদ আল-মাকরিযি লিখেছেন, ‘শিরটি যখন আনা হয়, তখনো রক্ত শুকায়নি এবং সেখান থেকে সুবাস বের হচ্ছিল।’

তবে, মিশরের কিছু মানুষ, বিশেষ করে যারা সালাফি মত বিশ্বাসের সাথে যুক্ত, তারা এ রীতি বা বিশ্বাসকে স্বীকার করেন না। তবে, হুসাইনের শির কোথায় সমাহিত হয়েছিল তা নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে।

তবে, ইতিহাসবিদরা এ বিষয়টিতে একমত যে, ইরাকে কারবালার যুদ্ধের পর শির ছাড়া ইমাম হুসাইনের দেহাবশেষ ৬১ হিজরির ১০ই মুহররম (১০ই অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) উৎবাহ হুসাইনিয়াতে সমাহিত করা হয়েছিল। কিছু বর্ণনায় জানা যায়, ইমাম হুসাইনের মাথা চল্লিশতম দিনে কারবালায় তার বাকি দেহাবশেষের সাথেই পাওয়া যায়।

হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শিয়া জুরি এবং হাদিস বিশারদ শরীফ আল-মুর্তাদা, হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর ইবনে আল-ফাতাল আল-নিসাবুরি এবং হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীর হাদিস বিশারদ সাইয়্যিদ ইবনে তাউস – তাদের বর্ণনাতেও এ তথ্য পাওয়া যায়। আবার কিছু বর্ণনায় জানা যায়, ইমাম হুসাইনের মাথা মদিনায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং তার মা ফাতিমা আল-জাহরার কাছে আল-বাক্বীতে দাফন করা হয়েছিল।

আরও কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সময়েই ইমাম হুসাইনের শির সিরিয়ার দামেস্কের রাজকীয় অস্ত্রগারের পাশে দাফন করা হয়েছিল। তবে মিশরে বহুল প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, ইমাম হুসাইনের কাটা মস্তক দামেস্ক থেকে ফিলিস্তিনি শহর আশকেলনে পাঠানো হয়েছিল।

ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ইতিহাসবিদ ইবনে আল-আযরাক আল-ফারকির তারিখ-ই-মিয়াফারাকিন বইয়ে ইমাম হুসাইনের শির নিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। প্রথমটিতে বলা হয়েছে, আশকেলনের মানুষ দামেস্ক থেকে ইমামের শির নিয়ে গিয়ে সেখানে বিপুল অর্থ ব্যয় করে একটি মাজার নির্মাণ করে। দ্বিতীয় বিবরণে উল্লেখ আছে, ক্রুসেডারদের আক্রমণের সময় খলিফা জাফর শিরটি আশকেলন থেকে মিশরে নিয়ে যান এবং সেখানেও একটি বড় মাজার তৈরি করেন।

ইবনে আল-আযরাকের এই হস্তলিপি ইমামের শির সমাহিত হওয়ার মাত্র ২০ বছরের মধ্যে লেখা, যা সময়ের দিক থেকে সবচেয়ে প্রাচীন। পরবর্তী ইতিহাসবিদ ইবনে আয়াস ও আল-মাকরিযি লিখেছেন, আশকেলন থেকে কায়রোতে শিরটি চামড়ায় মোড়ানো বাক্সে আনা হয়। তখনো এর রক্ত শুকায়নি, এবং সুবাস ছড়াচ্ছিল। পরে সেটি বিশেষ নৌকায় করে কায়রোর বর্তমান হুসাইনি মসজিদের কাছে সমাহিত করা হয়, যেখানে প্রবেশের আগে দর্শনার্থীরা এখনো কবরের সামনে ভূমি চুম্বন করে।

মিশরীয়দের সংস্কৃতির অংশ ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

ইমাম হুসাইনের জন্মোৎসবে হুসাইনি মসজিদজুড়ে চলে কোরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত, নবী ও তার পরিবারের জীবন নিয়ে আলোচনা, মিষ্টি বিতরণ এবং প্রার্থনা। এটি কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সামাজিক আনন্দোৎসবও।

ইমাম হুসাইনের নাম মিশরীয় সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত-নবী প্রশংসার নাতে, কবিতা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতে তার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিখ্যাত ক্বারি শেখ তাহা আল-ফাশনি তার কবিতায় লিখেছিলেন- ‘তার পবিত্র মুখ আলোকিত করেছে পুরো মিশরকে।’

মিশরীয়দের কাছে ইমাম হুসাইন শুধু ধর্মীয় নয়, আধ্যাত্মিক নেতা। তাকে ‘রাইস জুমহুরিয়াহ আল-বাতিন’ (আধ্যাত্মিক শাসক) ও ‘ওয়ালি আল-নাম’ (আশীর্বাদের প্রতীক) বলা হয়। নাওয়ারা নাজম বলেন, “তিনি প্রান্তিক, দরিদ্র ও নিপীড়িতদের নায়ক, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।”

ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগকে মিশরীয়রা বিষাদ নয়, বরং আনন্দের প্রতীক হিসেবে স্মরণ করেন, কারণ তাদের বিশ্বাস, তিনি মানবতার মুক্তি ও ন্যায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।

আট শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মিশরীয়রা ইমাম হুসাইনকে ভালোবেসে আসছেন। নাওয়ারা বলেন, ‘আমাদের এই ভালোবাসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে। আমি যেমন বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, তেমনি নিজের কন্যাকে তার গল্প বলি।’

হুসাইনি মসজিদের ইমাম ড. মোমিন বলেন, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যে হুসাইনকে ভালোবাসে, সে আল্লাহকে ভালোবাসে।’ তাই ইমাম হুসাইন কেবল মিশরের ইতিহাসের অংশ নন, তিনি মিশরীয়দের হৃদয়েরও অংশ, তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও আত্মার অবিচ্ছেদ্য প্রতীক।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © ajkerdorpon.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com